হাসান মীর
বেশ ক’দিন ধরে পরিচিতদের মুখে শোনা যাচ্ছে বিবিসি বাংলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কথাটা ঠিক নয়। বিবিসি বাংলা বন্ধ হচ্ছে না; বন্ধ হচ্ছে রেডিওতে বিবিসির বিভিন্ন অনুষ্ঠান। ডিজিটাল মাধ্যমে ও টেলিভিশনে বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান প্রচার অব্যাহত থাকবে। রেডিও সেটে অনুষ্ঠান আর শোনা যাবে না। বিবিসি বাংলা রেডিও অনুষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাভাষী মানুষের সম্পর্ক দীর্ঘ ৮১ বছরের আর তাই এই সম্প্রচার বন্ধ হওয়া নিয়ে এত কথা, এত উদ্বেগ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাভাষী শ্রোতাদের যুদ্ধের খবর শোনানোর জন্য ইংরেজ সরকার লন্ডনে তাদের সরকারি বেতার সম্প্রচার মাধ্যম বিবিসি থেকে ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর সপ্তাহে একদিন ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে। আমার জন্মও ১৯৪১ সালে। সেই অনুষ্ঠান ক্রমে জনপ্রিয়তা পায় এবং সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা-রাতে পরিবেশিত হতে থাকে। বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান রেডিওর শর্টওয়েভ ছাড়াও রেডিওর এফএম ব্যান্ডে শোনা এবং ইন্টারনেটেও একটি টিভি চ্যানেলে শোনা ও দেখা যায়। আগামী পহেলা জানুয়ারি থেকে রেডিওতে আর বিবিসি শোনা যাবে না। বলা হচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের ব্যয়সংকোচন নীতি এবং রেডিওর শ্রোতা কমে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিবিসি রেডিওর বাংলা অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। আমি তখন করাচিতে পাকিস্তান সরকারের একটি অফিসে চাকরি করি। আমার ছিল চার ব্যান্ডের একটি ফিলিপস ট্রানজিস্টার রেডিও অবসর সময়ে খবর আর রেডিও সিলোন এবং বিবিধ ভারতী থেকে প্রচারিত গান শুনতাম। তখন মিটার ব্যান্ড বা ফ্রিকোয়েন্সি সম্বন্ধে তেমন ধারণা ছিল না। একদিন সন্ধ্যায় রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে একটি অচেনা স্টেশন থেকে নজরুল গীতি শোনা গেল। পরে জানতে পারি সেটাই ছিল বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান আর অনুষ্ঠানের নাম ছিল সম্ভবত দিগন্ত বা প্রবাহ। প্রথম দিকে ভারত আর পাকিস্তানের বাঙালি শ্রোতাদের জন্য যে বিবিসি থেকে পৃথক অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো সে সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না।
একাত্তরের শুরুতে আমি ঢাকায় বদলি হয়ে আসি এবং ঘটনাচক্রে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগে প্রথমে অনিয়মিত ও পরে নিয়মিত কর্মী হিসেবে যোগ দিই। তখন রেডিও সম্প্রচার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ হলো। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রেডিওর গুরুত্ব বেড়েছিল। সরকারি রেডিও ছিল সম্পূর্ণ সরকারনিয়ন্ত্রিত, যাকে বলে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’। ফলে প্রকৃত তথ্য জানা বা খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য রেডিও পাকিস্তান ছাড়াও আকাশবাণী, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, বিবিসি, ভিওএ (ভয়েস অব আমেরিকা) প্রভৃতি রেডিওর খবর শুনতে হতো। তবে দখলদার আমলে বিদেশি রেডিওর অনুষ্ঠান শোনা ছিল বিপজ্জনক। শুনতে হতো লুকিয়ে এবং অত্যন্ত লো ভলিউমে। আমাদের অবশ্য একটা সুবিধা ছিল। বার্তা বিভাগের সঙ্গে বিদেশি রেডিওর অনুষ্ঠান শোনা বা মনিটর করার জন্য একটা মনিটরিং সেল ছিল। আমি অনেক সময় সেখান থেকে বিবিসি, আকাশবাণী এমনকি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের মনিটর করা খবরও শুনতাম।
যুদ্ধের সময় প্রপাগান্ডামূলক খবর স্বভাবতই বেশি থাকে। তবে খবর শুনলেই তা কতটা খাঁটি আর কতটা ভেজাল তা বোঝা যেত। মিথ্যা বা বানোয়াট খবর প্রচারে ভারত বা পাকিস্তানের কম-বেশি স্বার্থ থাকলেও বিবিসির সেই স্বার্থ ছিল না। তারা যতটা সম্ভব বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে এবং নিরপেক্ষভাবে সংবাদ ও মতামত প্রচারে উদ্যোগী ছিল। এ কারণেই মুক্তিকামী ও স্বাধীনতাপ্রত্যাশী বাঙালিদের কাছে বিবিসির গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। সেই গ্রহণযোগ্যতা সবটা না হলেও অনেকটাই বিবিসি বাংলার নীতিনির্ধারকরা ধরে রাখতে পেরেছেন বলে মনে করি।
এ কারণেই আমার মতো অনেক শ্রোতা সরকারি ও অন্যান্য গণপ্রচারমাধ্যমের চেয়ে বিবিসির খবর ও প্রচারিত মতামতের ওপর বেশি আস্থা রাখেন; প্রবাহ আর পরিক্রমা শীর্ষক দুটি অনুষ্ঠান না হোক, একটি অন্তত শুনতে ভুল করেন না। আমি অনুষ্ঠান শোনার পাশাপাশি একসময় নিয়মিত চিঠি লিখে অভিমত জানাতাম। সাম্প্রতিককালে শারীরিক সমস্যার কারণে আর চিঠি লেখা হয় না, তবে আনন্দের কথা, অভিমত অন্তত বার চারেক বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠানে আমার স্বকণ্ঠে প্রচারিত হয়েছে। বাংলা বিভাগের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় আমার ছবিসহ একটি লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল। এসবই এখন অতীত।
পহেলা জানুয়ারি থেকে যেহেতু আর রেডিওতে বিবিসি শোনা যাবে না তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এর অনুষ্ঠানসূচি ও অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসবে। সেই পরিবর্তন কতটা এবং কীভাবে হবে তা দেখার অপেক্ষায় আছি। আমি চাই না, বিবিসি বাংলা তার চেহারা-চরিত্র পুরো হারিয়ে ফেলে অচেনা হয়ে যাক।
লেখক : বিবিসি বাংলার নিয়মিত শ্রোতা, বাংলাদেশ বেতারের অবসরপ্রাপ্ত সংবাদকর্মী