নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজশাহী শিশু হাসপাতালের নির্মাণ কাজ চলছিল খুব ঢিমেতালে। সেই কাজ অবশেষে শেষ হয়েছে। কিন্তু নির্মাণের এক বছরের বেশি সময় ধরে হাসপাতালটি পড়ে আছে। গণপূর্ত বিভাগের কাছ থেকে হাসপাতালটি বুঝে নেওয়া হচ্ছে না। গণপূর্তের কর্মকর্তারা বলছেন, হাসপাতালটি কোন দপ্তরের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে সেই নির্দেশনা পাচ্ছেন না তারা।
২০০ শয্যার এই বিশেষায়িত হাসপাতাল পড়ে আছে দিনের পর দিন। পূর্ণাঙ্গ এই শিশু হাসপাতালটি খালি পড়ে থাকলেও অন্তত ২০ জেলার শিশু রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল। এখানে তিনটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলছে শিশুদের। এক শয্যাতেই রাখা হচ্ছে তিন-চারজন শিশুকে। তারপরও নতুন হাসপাতাল চালুর উদ্যোগ নেই।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের এখানে শিশু রোগীরে প্রচুর চাপ। আমরা হিমশিম খাই। আলাদাভাবে নতুন পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল চালু হলে আমাদের এখানে চাপ কমবে। তখন আমরা অন্য রোগীদের আরও ভালো সেবা দিতে পারব। তাই যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালটা চালু করা দরকার।’
রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ-২ জানিয়েছে, নগরীর বহরমপুর টিবিপুকুর এলাকায় শিশু হাসপাতালের চারতলা ভবনের নির্মাণ কাজই শেষ হয়েছে এক বছর আগে। ইতোমধ্যে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), বৈদ্যুতিক পাখা, সোলার প্যানেল, পাম্প মোটরসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজশাহী সফরে গিয়ে হাসপাতালের উদ্বোধনও করেছেন। এখন হাসপাতালটি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো দপ্তরই এটি বুঝে নিতে আসছে না।
ঢিমেতালে নির্মাণে বাড়ে ব্যয়: নবনির্মিত এই হাসপাতালের জায়গায় আগে জরাজীর্ণ সরকারি কোয়ার্টার ছিল। সেগুলো ভেঙে পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সেই অনুযায়ী হাসপাতাল নির্মাণ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। ২০১৫ সালের মে মাসে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের জুনে। কিন্তু শুরুতেই নকশা নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। প্রথমে ১০তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা নেমে আসে চারতলায়। ১০তলা ভবনটি করার পরিকল্পনা ছিল ১৬ হাজার বর্গফুটের। এটি পরিবর্তন করে ২৭ হাজার বর্গফুট করা হয়। এই নকশা সংশোধনের পর পুরনো ভবন অপসারণের পর কাজ শুরু করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। তাতেও কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। এরপর আবার ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ে। ওই মেয়াদ পার হওয়ার পর বছরখানেক আগে কাজ শেষ হয়েছে। প্রথম মেয়াদে কাজের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৩ কোটি টাকা। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়তে বাড়তে ব্যয়ও বেড়ে এখন প্রায় ৩৪ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে আড়াইগুণেরও বেশি।
হাসপাতালে যা আছে: হাসপাতালের প্রথম তলার আয়তন ১৯ হাজার বর্গফুট। এখানে রয়েছে ১৪ শয্যার জেনারেল অবজারভেশন ইউনিট। এখানে এক্স-রে করানোর জন্য দুটি এবং সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করানোর জন্য একটি করে কক্ষ রাখা হয়েছে। স্টোর হিসেবে রয়েছে ৮টি কক্ষ। নিচতলায় একসঙ্গে ২০টি গাড়ি পার্কিংয়েরও ব্যবস্থা রয়েছে। ২০ হাজার ২২৫ বর্গফুটের দ্বিতীয় তলা রয়েছে একটি মাইনর ওটি ও ৪টি বিশেষায়িত ওটি। এ ছাড়া ১০ শয্যার প্রি ও পোস্ট ওটি এবং ৫৬ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ইউনিট করা হয়েছে। চতুর্থ তলায় রয়েছে শিশুদের ৯৬ শয্যার সাধারণ ওয়ার্ড এবং ১৮ শয্যার পেয়িং শয্যা। হাসপাতালে রোগী ভর্তি রাখার পাশাপাশি বহির্বিভাগে চিকিৎসাও দেওয়া হবে। তাই তৃতীয় তলায় চিকিৎসকের জন্য করা হয়েছে ১৮টি কক্ষ। হাসপাতালে থাকবে ক্যান্টিন, ল্যাব এবং অফিস ব্লক। মোট সাতটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছে।
গণপূর্তের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতাল ভবন নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৩ কোটি টাকা। জেনারেটর কেনা ও সাব স্টেশন নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। বৈদ্যুতিক পাখা, এসি, সোলার প্যানেল এবং অগ্নি নির্বাপনসামগ্রী বসানো হয়েছে আরও প্রায় দেড় কোটি টাকায়। প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে সাব-স্টেশন এবং আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভার নির্মাণ করতে। দুটি লিফট কিনতে খরচ হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। পুরো হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ লাইন বসাতে খরচ হয়েছে আরও প্রায় ২ কোটি টাকা। সবকিছুই প্রস্তুত। এখন শুধু হাসপাতালের সীমানা প্রাচীরের গ্রিল লাগানোর কাজটুকু বাকি। চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ঠিকাদার এই গ্রিল লাগাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ।
ভেতরে মাদকসেবীদের আড্ডা: সরেজমিনে হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, নতুন ভবনটি তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। হাসপাতালের ভেতরের রাস্তাগুলোও পাকা করা হয়েছে। সীমানা প্রাচীরের কাজও শেষ হয়েছে। হাসপাতালটির ভেতরে এখানে-ওখানে পড়ে আছে খালি ফেনসিডিলের বোতল।
সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজের দেখাশোনা করা ঠিকাদারের এক কর্মচারী জানান, প্রতিরাতে ভেতরে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। অনেকে দিনের বেলায় এসে এখানে ফেনসিডিল সেবন করেন। এসবের প্রতিবাদ করা যায় না। কিছু বলতে গেলেই মাদকসেবীরা মারতে আসে। মাদকসেবীদের জন্য বাইরে কিছু ফেলে রাখা যায় না। প্রতিনিয়ত নানা জিনিসপত্র চুরি হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, ‘রাজশাহীতে ২০ জেলার শিশুরা চিকিৎসা নিতে আসে। এ জন্য নাগরিক সমাজের দাবির প্রেক্ষিতে হাসপাতালটা নির্মাণ করা হয়েছে। এখন এটি চালু না করে ফেলে রাখা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করি, যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারি অংশ বা অবকাঠামো নির্মাণ ও কেনাকাটার কাজগুলো দ্রুত হয়ে যায়। কিন্তু পরে আর এগোতে চায় না। এটি কেন হয় তার তদন্ত প্রয়োজন। দোষীদের শাস্তি দেওয়া দরকার। হাসপাতালটি চালু না হওয়া রাজশাহীর রাজনৈতিক নেতাদেরও ব্যর্থতা। তারা হাসপাতালটি চালু করতে পারছেন না।’
যা বলছেন কর্মকর্তারা: হাসপাতাল নির্মাণ কাজের তদারকির দায়িত্বে ছিলেন রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ-২ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের নির্মাণ কাজ এক বছর আগে শেষ। প্রথম দফায় করা রং উঠে যাওয়ায় একমাস আগে আবার করালাম। কিন্তু হাসপাতাল কেউ বুঝে নিচ্ছেন না। রামেক হাসপাতাল, সিভিল সার্জনের কার্যালয় নাকি বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরকে এই হাসপাতাল বুঝে নেবে আমরা তাও জানি না।’
তিনি বলেন, ‘অন্য কাজে দেখি সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা কর্মকর্তারা আমাদের দ্রুত কাজ শেষ করতে তাগিদ দেন। এখানে কাজ শেষ করে বসে আছি কারও কোনো খোঁজ নেই। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের অনেকবার বলেছি ভবন বুঝে নিতে, কিন্তু তারা নিচ্ছেন না। কেন নিচ্ছেন না সেটি বলতে পারব না।’
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মো. ফারুক এই হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল নির্মাণ শেষ হলে তো আমাদের চিঠি দিয়ে গণপূর্ত জানাবে। কিন্তু এখনও জানায়নি।’
চিঠি না দেওয়ার বিষয়ে গণপূর্তের কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম খান বলেন, ‘নির্মাণ কাজ একটা চলমান প্রক্রিয়া। হস্তান্তরের আগের দিন পর্যন্ত এটি আমাদের তত্ত্বাবধানে থাকে এবং টুকটাক কাজের প্রয়োজন হতে পারে। সে জন্য চিঠি দেই না। কাজ যে শেষ হয়েছে সেটা স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট সবাইকেই মৌখিকভাবে বলা হয়েছে।’
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আনোয়ারুল কবীর বলেন, ‘হাসপাতালের কাজ শেষ হওয়ার বিষয়টি আমরা জানি। এখন চালু করতে হলে জনবল প্রয়োজন। অন্যান্য মেডিকেল সামগ্রীও দরকার। বিষয়টি একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। কিন্তু সেখান থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি। তাই আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘জনবল না হয় আমরা দেব, কিন্তু মেডিকেল সামগ্রীগুলো দিতে হবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে। এ জন্য কিছু প্রক্রিয়ার ব্যাপার আছে। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে বসব।’