এফএনএস
দেশের প্রথম এলিভেটেড মেট্রোরেল উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আর এর মধ্যদিয়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ছয় মাসের ব্যবধানে দেশের যোগাযোগের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক স্থাপিত হল। গতকাল বুধবার তিনি রাজধানীর দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬-এর দিয়াবাড়িতে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে আংশিকভাবে উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মেট্রো রেলের উদ্বোধন উপলক্ষে ৫০ টাকার একটি স্মারক নোটও প্রকাশ করেন। তিনি রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি খেলার মাঠে একটি নাগরিক সমাবেশে ভাষণ দেন যা বিরাট জনসভায় পরিণত হয়। সকালে মেট্রোরেলের উদ্বোধনের পর সুধী সমাবেশ শেষে দুপুর দেড়টায় মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশনে গিয়ে ফটোসেশনে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। পরে সেখানে বৃক্ষরোপণ করেন এবং দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর অর্থ পরিশোধ করে মেট্রোরেলের টিকিট কাটেন তিনি। এ সময় শেখ রেহানাও টিকিট কাটেন। পরে একে একে দুই শতাধিক সফরসঙ্গী টিকিট কাটেন। এদিকে মেট্রোরেল উদ্বোধন ঘিরে সকাল থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ী ও আগারগাঁও স্টেশনে উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও অনেকে মেট্রোরেল দেখতে আসেন। সরকারের এ সাফল্যে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এদিন বেলা পৌনে ১১টার দিকে মেট্রোরেলের এক নম্বর স্টেশন উত্তরা উত্তর স্টেশনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। বেলা ১১টার দিকে উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরের ‘সি’ ব্লকের মাঠে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ বৃহৎ অবকাঠামো উদ্বোধন করেন তিনি। মেট্রো ট্রেনের প্রথম চালক হয়েছেন মরিয়ম আফিজা। গতকাল বুধবার বৃহস্পতিবার থেকে সাধারণ মানুষ মেট্রোরেলে চড়া শুরু করতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উত্তরা স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত কোনো স্টপেজ ছাড়াই চলাচল করবে মেট্রো ট্রেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) মেট্রো রেল স্টেশন থেকে যাত্রী পরিবহনের জন্য ৩০টি ডাবল ডেকার বাস পরিচালনা করবে। এর মধ্যে ২০টি বাস ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ও গুলিস্তান হয়ে আগারগাঁও-মতিঝিল রুটে এবং ১০টি বাস উত্তরার হাউস বিল্ডিং থেকে আবদুল্লাহপুর হয়ে উত্তরার দিয়াবাড়ির উত্তর স্টেশন পর্যন্ত চলাচল করবে। সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) মেট্রোরেল প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মেট্রোরেল নির্মাণ করছে এবং প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে। ২০১৬ সালে এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় সেকশন এবং মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত তৃতীয় সেকশন পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে। আগামী ডিসেম্বরে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হবে। মেট্রো রেল প্রতি ঘন্টায় ৬০ হাজার যাত্রী এবং প্রতিদিন অর্ধ মিলিয়ন যাত্রী বহন করতে সক্ষম হবে এবং প্রতি চার মিনিটে প্রতিটি স্টেশনে একটি ট্রেন আসবে। ঢাকায় এলিভেটেড মেট্রোরেল-এ এখন পর্যন্ত অদৃশ্য পরিবহনের নতুন মোড দিয়ে যাতায়াতের নতুন যুগে যাত্রা শুরু করতে চলেছে বাংলাদেশ। মেট্রোরেলটি আরামদায়ক উপায়ে কম সময়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করায় জনদুর্ভোগ অনেকটাই কমবে। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি মেট্রোরেল চালু হলে সম্পূর্ণ চালু হলে রাজধানীর যানজট কমবে। প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ছয়টি বগি বিশিষ্ট ১০ সেট ট্রেন চলবে। ১০-সেটের ট্রেনের কোনটিতে কখনো সমস্যা দেখা দিলে সহায়ক হিসেবে থাকা বাকি দুটি বিকল্প হিসেবে চলবে। আপাতত এই রুটে ধীরগতিতে ট্রেন চলবে। তবে পূর্ণ গতিতে ট্রেন চলাচল শুরু হলে প্রতি সাড়ে তিন মিনিটে একটি করে ট্রেন চলবে। ট্রেন কোন স্টেশনে কতক্ষণ থাকবে তা এখনও ঠিক হয়নি। প্রতিটি স্টেশনে, যাত্রীদের বোর্ডিং এবং নামা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ট্রেনটি অপেক্ষা করবে। প্রতিটি ট্রেন ২,৩০০ যাত্রী নিয়ে ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। তবে বাঁকযুক্ত এলাকায় গতি কম হবে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাজধানীর ওপর চাপ কমাতে নানা উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। যানজট নিরসনে রাজধানীজুড়ে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে প্রকল্পের বিবরণে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ২৪ জুন মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন, যা এমআরটি লাইন-৬ নামে পরিচিত। পরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নগরীর আগারগাঁও পয়েন্টে এলিভেটেড ভায়াডাক্টের প্রথম অংশ এবং এমআরটি লাইন-৬ এর নয়টি স্টেশনের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। মোট ২২,০০০ কোটি টাকার প্রকল্পের মধ্যে জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) প্রায় ১৬,৬০০ কোটি টাকা প্রকল্প সহায়তা হিসেবে প্রদান করেছে।
আগারগাঁও স্টেশনে উৎসুক জনতাকে অভিবাদন প্রধানমন্ত্রীর
রাজধানীর দিয়াবাড়ী থেকে মেট্রোরেলে করে আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের নানা স্তরের নেতাকর্মী ও উৎসুক জনতা। তাদের দেখে প্রধানমন্ত্রী হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান। তার সঙ্গে ছোটবোন শেখ রেহানাও ছিলেন। গতকাল বুধবার দুপুর ২টা ১৭ মিনিটে আগারগাঁও স্টেশন থেকে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন বঙ্গবন্ধুর এই দুই কন্যা। এসময় সব প্রটোকল ভেদ করে সবার সামনে এসে উৎসুক জনতাকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। এর আগে দুপুর ১টা ৫৪ মিনিটে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে করে যাত্রা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর মাত্র ১৭ মিনিটে আগারগাঁও পৌঁছান তিনি। মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন শেখ রেহানাসহ পরিবারের ১০ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম, পোশাককর্মী, রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। প্রায় ১২ কিলোমিটারের এই পথে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী মেট্রোরেলটির চালক ছিলেন মরিয়ম আফিজা।
ডাক টিকিট ও ৫০ টাকার স্মারক নোট উন্মোচন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাক টিকিট ও ৫০ টাকার স্মারক নোট উন্মোচন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার দুপুর ১টায় উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের সি-১ ব্লকের খেলার মাঠে সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার পর এ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন তিনি। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন জাতির পিতার কনিষ্ঠ কন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা। এ ছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালকদার উপস্থিত ছিলেন। অন্যান্যের মধ্যে অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনুল্লা নুরী, ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকার চেহারা বদলে দেবে মেট্রোরেল: জাপানি রাষ্ট্রদূত
আমরা সত্যিই গর্বিত যে জাপান কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের ইতিবাচক উন্নয়নের সাক্ষী হয়েছে। রাষ্ট্রদূত হিসেবে এই উন্নয়নের সঙ্গে চলতে চাই। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে কাজ করব। আমি বিশ্বাস করি ঢাকার চেহারা বদলে দেবে মেট্রোরেল। গতকাল বুধবার মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর সুধী সমাবেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনিরো এসব কথা বলেন। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী প্রান্তে গতকাল বুধবার বেলা ১১টা ৪ মিনিটে মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকে। উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। গতকাল বুধবার উদ্বোধন হয় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের, যার দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ইওয়ামা কিমিনিরো বলেন, দ্রুতগতির মেট্রোরেল সেবার মধ্য দিয়ে ঢাকার চেহারা বদলে যাবে। সত্তর দশকের শুরু থেকে জাপান বাংলাদেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও নিরলস কাজ করছে। বাংলাদেশ এখন এশিয়ায় দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। একই সঙ্গে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন বাংলাদেশ দেখছে তা পূর্ণতা পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন ইওয়ামা কিমিনিরো। আমরা খুবই গর্বিত যে জাপান কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের এই ইতিবাচক উন্নয়নের সাক্ষী হয়েছে। নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে এই উন্নয়নের সঙ্গে চলতে চাই। তিনি বলেন, ঢাকার সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের চলাচলে এই সংযোজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি একটি নিরাপদ পরিবহন, বিশেষ করে নারীদের জন্য। সুধী সমাবেশে উপস্থিত আছেন প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।