নিজস্ব প্রতিবেদক
‘আমার ভাই পুলিশে চাকরি করেন। তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ছিলেন। ভাইয়ের কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ভাইয়ের কলিগের ছোট ভাই ফায়ার সার্ভিসে চাকরির পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন। তার সঙ্গেই ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে বেড়াতে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া। ভাগ্যক্রমে চাকরিটাও পেয়ে যাই। অনেকেই ডুবুরির বিষয়ে ভয় পায়। আসলে পানির নিচে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। আমরা শুধু শুধু ভয় করি।’
রাজশাহী সদর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের প্রধান আব্দুর রাজ্জাক। শনিবার (২২ জুলাই) রাজশাহী নগরীর সাতবাড়িয়া এলাকায় পদ্মা নদীতে নিখোঁজ দুই কিশোরের উদ্ধার অভিযানের সময় নিজের দীর্ঘ ২০ বছরের চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন তিনি।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমার বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার হরিপুর গ্রামে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদী। নদীর পাড়েই আমার বেড়ে ওঠা। সাঁতার তো জানতামই সেই সঙ্গে পানি সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ভালো ধারণা ছিল। যার কারণে এই চাকরিটা আমার কাছে খুব সহজ মনে হয়েছে। এটা সেবাধর্মী চাকরি। মানুষের উপকার করতে পারলে অনেক ভালোলাগা কাজ করে। মানুষের স্বজনরা নদী বা পুকুরে নিখোঁজ হলে আমাদের খবর দেন। আমরা উদ্ধার করি। অনেক সময় পানিতে নিখোঁজ মানুষকে উদ্ধারে যেতে ভয় পায় মানুষ। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা তেমন না। পানির নিচে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। আমার চোখে কখনো ভয় পাওয়ার মতো কিছু পড়েনি।
তিনি আরও বলেন, চাকরিতে যোগদান ২০০৩ সালে। সেই হিসেবে চাকরির বয়স ২০ বছর। খুলনা বিভাগে ২০১০ সাল পর্যন্ত ডুবুরি পদে নিয়োজিত ছিলাম। এরপর বদলি হয়ে রাজশাহীতে আসা। এখনো রাজশাহীতেই আছি। বর্তমানে ডুবুরি দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। পদ্মা, যমুনা নদী ছাড়াও ছোট বড় মিলে অনেক নদী ও পুকুর রয়েছে। আমাদের ডাক পড়লে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করি। একসময় পুরো বিভাগে আমরা মাত্র তিনজন ডুবুরি ছিলাম। গেল চার বছরে আমাদের সঙ্গে আরও তিনজন ডুবুরি যুক্ত হয়েছে।
উদ্ধার অভিযানের বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের উত্তরাঞ্চলে বসবাস। এই অঞ্চলে পানির ধারা আগ মুখ। দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে জোয়ার-ভাটা হয়। যার কারণে ছয় থেকে আট ঘণ্টা পরে পানি উঠানামা করে। একসময় স্বাভাবিক পর্যায় থাকে। এই নদীগুলোতে জোয়ার আর ভাটার মাঝে একটা নীরব নদী পাওয়া যায়। আমরা সাধারণত সেই সময়টায় কাজ করি। ফলে উদ্ধার অভিযানে বেগ পেতে হয় না। উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর পানির প্রবাহ শুধু একদিকেই যেতে থাকে। যার কারণে নীরব নদীর যে সুযোগ সেটা আমরা পাই না। সেই কারণে আমাদেরকে ধীরে ধীরে খোঁজ করে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, ডুবুরিদের কাছে গভীরতা বড় বিষয় না। মূল বিষয় হচ্ছে পানির স্রোত। নদীতে বেশি স্রোত হলে ডুবুরিদের কাজ করতে সমস্যা হয়। তারপরও আমরা উন্নতমানের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকি। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা পানির তলদেশে কাজ করি। স্বচ্ছ পানি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। একজন সাধারণ মানুষ পানির নিচে যতটুকু দেখতে পান, ডুবুরিরাও ঠিক ততটুকুই দেখতে পায়। যেহেতু নদীর পানি ঘোলা, তাই সাবধানতা অবলম্বন করে আমাদেরকে কাজ চালিয়ে যেতে হয়।
উদ্ধার অভিযানে শনাক্তের বিষয়ে এই ডুবুরি বলেন, আমরা পানির নিচে সার্চ করে থাকি, সেটি কয়েকভাবে। লাইন সার্চ, গোল আকারের সার্চ। দাঁড়িয়ে ছাড়াও অনেক সময় পানির তলদেশে মাটিতে শুয়ে সার্চ করা হয়। পানির নিচে আক্রমণ করার মতো কিছু নেই। আমরা বিভিন্ন কথা ভেবে ভয় পাই। আসলে তেমন কিছু না। আমার প্রথম উদ্ধারের অভিযান ছিল খুলনার কীর্তনখোলা নদীতে। সেখানে ১৫০ জন লোক নিয়ে একটি জাহাজ ডুবে যায়। সেই ঘটনায় ৪৫ জন মৃত মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছিল।
এই পর্যন্ত কত মরদেহ উদ্ধার করেছেন এমন প্রশ্নে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমার চাকরি জীবন ২০ বছর। এই সময়ে পানির নিচ থেকে পাঁচ শতাধিক ডুবে যাওয়া মানুষের মরদেহ উদ্ধার করেছি।
রাজশাহী সদর ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুর রউফ বলেন, রাজশাহীতে ছয়জন ডুবুরি আর একজন লিডার। এই সাতজনকে নিয়ে দুইটা ইউনিট। এক ইউনিটে তিনজন করে। তারা রাজশাহী বিভাগের সব জেলায় উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। আমাদের এই ডুবুরিরা অনেক দক্ষ। আল্লাহর রহমতে আমাদের রাজশাহীতে উদ্ধার অভিযানে গিয়ে কোনো ডুবুরির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।