আলতাফ হোসেন
সাধারণ মানুষের ওপর রেকর্ড মূল্যস্ফীতির চাপ, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে অদক্ষতা, রিজার্ভ ও ডলার সংকটের মতো বিষয়গুলোও মাথায় নিয়ে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ স্লোগানে আজ বৃহস্পতিবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর এটি প্রথম বাজেট। এ ছাড়া টানা চতুর্থ মেয়াদে গঠিত বর্তমান সরকারের এটি প্রথম বাজেট এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ২১তম বাজেট। এবার বাজেট রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে ঘাটতি হতে পারে ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, যা সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল এক দশক আগে। এই ঘাটতি মেটাতে সরকারের বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই খাত থেকে ১ লাখ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি মেটানো হতে পারে। বাকি ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি মেটানো হবে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে প্রতি বছর বাজেট বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ১১ শতাংশ। সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন। তার সেই বাজেট ছিল আগের বছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগের বছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি বাজেট পেশ করেছিলেন। এবারের বাজেট চলতি বছরের তুলনায় মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি হতে পারে। এরপরও এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আকারের বাজেট। চলতি অর্থবছরের বাজেট আগের বছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি। এমনকি মহামারি চলাকালীনও আগের বছরের চেয়ে বাজেট বেড়েছিল প্রায় ৯ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজেটের আকার প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ানো সম্ভব নয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং ডলার সংকটের সমাধান করা। তাদের ভাষ্য, সরকার চায় মাঝারি আকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশের বেশি ছিল। কিন্তু আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সরকার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অথচ গত বছরের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ৯ শতাংশের বেশি।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, আমাদের মূল লক্ষ্য অর্থনীতিকে অনট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে নিত্যপণ্য যাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, এগুলো নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে সরকার যে নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছিল, সেটির একটা রিফ্লেকশন দেখতে চাই। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ থাকবে মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়। আমরা সংকোচনমূলক সময় পার করছি। সংকোচন থেকে কীভাবে সম্প্রসারণ করা যায়, সেটিই চেষ্টা করছি। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন সামনে রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। সর্বোপরি আগামী বাজেটে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, সামগ্রিকভাবে বলা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রফতানিপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রান্তিক মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবারের বাজেটের অগ্রাধিকারে থাকবে। নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। এবার বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। পাশাপাশি নিম্নআয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া যেসব খাত দীর্ঘদিন কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে আসছে, সেসব খাত থেকে কর অব্যাহতির সুবিধা উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, চলমান সংকটের তিনটি দিক রয়েছে-উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট এবং আর্থিক সংকট। তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর পক্ষে রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন, কিন্তু অর্থনীতির জন্য এটা প্রয়োজন। গত নির্বাচনে যারা সরকারের পাশে ছিলেন, তারা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করবেন।’ এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীকে অর্থনৈতিক চাহিদা এবং বড় খেলোয়াড়দের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে। বাজেটের সাফল্য কেবল এই ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করবে’।
বাজেট ঘাটতির আকার নিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এমন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার কম হওয়া উচিত। ‘তাহলে সেটা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমানোর জন্য ভালো হবে। এ ছাড়া, বেসরকারি খাতও পর্যাপ্ত ঋণ পাবে।’
সরকার প্রথমবারের মতো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে নিজস্ব অর্থায়ন কমাতে যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরে সর্বোচ্চ ব্যয় হবে সুদ পরিশোধে ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা, ভর্তুকি ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও পেনশন ১ লাখ কোটি টাকা।
রাজস্ব সংগ্রহে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে সরকার, যা আগের বছরের তুলনায় আট শতাংশ বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এবারের বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত সম্পদের বৈধতা নেওয়ার সুযোগ থাকতে পারে।
সরকারি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি ধরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সাজানো হচ্ছে। রাজস্ব আহরণের এ লক্ষ্য ঠিক করলে চলতি অর্থবছরের তুলনায় অনেক বেশি টাকা জোগাড় করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। এ ছাড়া নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না করা হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি বাতিল করা হতে পারে কিংবা এটি দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে এক শতাংশ করা হতে পারে।
সম্প্রতি গণভবনে অনুষ্ঠিত ২০২৪-২৫ সালের বাজেট প্রস্তুতির সারসংক্ষেপ উপস্থাপন-বিষয়ক বৈঠকে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটকেও ব্যয় সংকোচনমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী বাজেটেও বিলাস-পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে আগামী বাজেটের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, শুধু পরিকল্পনা করলেই হবে না, অর্থ তো নাই। মূল সমস্যা হচ্ছে, অর্থনীতির ওপর আমাদের আস্থা চলে গেছে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা কমে গেছে।
মূল্যস্ফীতি আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভ কমে যাওয়ার পাশাপাশি চাপ বেড়েছে মূল্যস্ফীতির। গত বছরের মার্চ থেকে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। এজন্য বাজেটের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ যেন না বাড়ে, সে দিকে নজর দিতে হবে এটাই মূল চ্যালেঞ্জ।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে হবে। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে অর্থনীতির ওপর আস্থা থাকবে না। আমরা এদিক-সেদিক করলেই খাদে পড়ে যেতে পারি। কারণ আমাদের রিজার্ভ নেই।
রাজস্ব আহরণ নিয়ে তিনি বলেন, লক্ষ্য যদি ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ধরে থাকে তাহলে আমি বলব, এটা বাস্তবতা ও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক বেশি ধরা হয়েছে। সঠিক নীতি কৌশল অবলম্বন করা হলে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা গেলে এটা যে অর্জন সম্ভব না তাও বলা যাবে না। কিন্তু আমরা অতীতে দেখেছি যে, রাজস্ব আহরণের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা কখনও বাস্তবায়ন করা যায়নি।
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ব্যয় বরাদ্দ রেখে বাজেট পরিকল্পনা করা হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র: খোলা কাগজ
বাংলার কথা/জুন ০৬, ২০২৪