বাংলার কথা ডেস্ক
‘প্রস্রাব করার সময় আমাকে বিদ্যুতের শক দেয়। হাতে একটা ইনজেকশন দেয়। ওরা আমার অন্ডোকোষে জোরে জোরে আঘাত করে। বার বার আমার মনে হচ্ছিল আমি মরে যাব।’— জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলনে এমনই ভয়ংকর নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জবি সমন্বয়ক নূর নবী।
শুক্রবার (৯ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করেন কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে নির্যাতনের শিকার নূর নবী বলেন, ‘আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এডিসি বদরুল আমাকে ডেকে আলাদা করে। ডিবির পাঁচটা গাড়ি এসেছিল। তারা শুধু আমাকে এখান থেকে উঠিয়ে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠিয়েই আমাকে মার শুরু করে। বিশেষ করে সহকারী কমিশনার গোলাম মোস্তফা এবং তার সাথে যারা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘যখন আমাকে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়, তখন আমি ভেবেছিলাম গাড়িতে যে টর্চার করা হয়েছে, এর চেয়ে বেশি টর্চার আর হতে পারে না। আমাকে হয়ত এখন তারা ছেড়ে দেবে না হয় গ্রেপ্তার দেখাবে। কিন্ত এর চেয়ে যে পাশবিক নির্যাতন যে তারা করতে পারে, তা আমার কল্পনায় ছিল না। আমাকে যখন ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়, তখন চোখে কালো কাপড় বেঁধে দেয়। শুরুতে এক চেয়ারে বসিয়ে আমার শরীরের সব কাপড়চোপড় খুলে ফেলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে মারছিল আর বারবার বলছিল, তোর তথ্য আমরা অনেক দিন থেকে শুনেছি, ক্যাম্পাস থেকে কয়েকজন তোর কথা আগেই বলেছে। তুই জঙ্গি, তুই শিবির। শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে বলেছে, তুই ছাত্রদল করিস। তারা যেভাবে আমাকে মেরেছিল, আমি ভেবেছিলাম আমার পায়ের অংশ পচে যাবে বা কেটে ফেলতে হবে।’
‘আমাকে চিত করিয়ে শুইয়ে বলে তোর এক হাত তো ছাত্রলীগ ভেঙেছে, আরেক হাত আমরা ভেঙে দেব। আমার নাভির নিচ থেকে হাঁটু পর্যন্ত মারধর করে। রুটি যেভাবে বেলে ঠিক সেভাবে আমার হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত লাঠি দিয়ে চাপ দেয়। আমি কান্না করলেই বলত তোকে মেরেই ফেলব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে এভাবে মারত।
‘পুলিশ গত ১৫ জুলাই থেকে আমার ফোন ট্র্যাক করছিল। অনেকের বাসায় ছাত্রলীগ কর্মীরা বন্দুক তাক করে। আমি আমার মায়ের থেকে ১৭ তারিখ বিদায় নিয়েছিলাম এই বলে যে, আমি মরে গেলে কেঁদো না। আর বেঁচে থাকলে বিকেলে ফোন দেব। এই ভয়েস রেকর্ডটা তারা শুনিয়ে শুনিয়ে মেরেছে। একপর্যায়ে ওরা আমার হাত-পা দুই দিক করে পা দিয়ে চেপে ধরে।’
‘পরবর্তীতে তারা আমার থেকে বিএনসিসির কার্ড পায়। তখন বলে, আমি এত শক্ত কেন? এ জঙ্গি, সে জঙ্গি ট্রেনিং নিয়েছে। আমি এটা বলতে পারিনি যে আমি সেনা মহড়ায় অংশ নিয়েছি, আমি অন্তত জঙ্গি হতে পারি না। আমাকে উলঙ্গ অবস্থায় রেখে দেয়। একটা সময়ে বিকেলে ডিবি হারুন এসে বলে একে বাঁচিয়ে রাখছ কেন? একে ক্রসফায়ার দে। আমার দুই হাঁটুতে হাতুলি দিয়ে পিটিয়ে ওরা ভেঙে ফেলে। আমি ভেবেই নিয়েছিলাম আমাকে মেরেই ফেলবে।’
‘কারাগারে নেওয়ার পর আমি অনেক গার্ডকে কান্না করে বলেছি, আমাকে হাসপাতালে নেন। আমাকে হাসপাতালে নেয়নি। কারাগারে পানিতে মরিচ দিয়ে রাখা হত যেন পানি খেতে না পারি, গোসল করতে না পারি।’
নূর নবী বলেন, ‘ডিবি পুলিশ আমাকে বলে, তোকে ক্রসফায়ার দেব। তুই রেডি হয়ে নে। আমরা ছয়জন ছিলাম মোট। রমনায় নিয়ে আমাদের চোখ খুলে দেওয়া হলো। আমার হাতে পেট্রোল বোমা ধরায়ে দিল। ভিডিও করা শুরু করল। তারা যে এভাবে মামলা সাজাবে আমি ভাবতেও পারিনি। দেশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ এ রকম পর্যায়ে যাবে ভাবিনি। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ দেশের মানুষের আস্থার জায়গা হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক তারা আমাকে মারেনি। আমি বেঁচে ফিরেছি। স্বাধীন দেশে আবার ফিরতে পেরেছি। এটা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা।’
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক, মাসুদ রানা, সোহান, স্বর্না আক্তার রিয়া, মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়সাল উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাইমা আক্তার রিতা, বিএম তানজীল, শাহিন আলম শান ও স্বপনসহ অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র: যুগান্তর
বাংলার কথা/আগস্ট ০৯, ২০২৪