• ঢাকা, বাংলাদেশ শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৯ অপরাহ্ন
শিরোনামঃ
রাজশাহীতে সাবেক এমপিকে বহনকারী প্রিজনভ্যানে হামলা পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির বইয়েও আসছে পরিবর্তন সংখ্যালঘুদের ‘টার্গেট’ করে সহিংসতার ঘটনায় ৮৮ মামলা, ৭০ জন গ্রেপ্তার নবজাতকের মরদেহ আটকিয়ে ২০ হাজার টাকা আদায়! চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-ছেলেসহ নিহত ৩ মধ্যরাতে হামলায় আ. লীগকে দায়ী করে যা বললেন হাসনাত শেখ হাসিনার বক্তব্য বাংলাদেশ পছন্দ করছে না : দিল্লিকে পররাষ্ট্র সচিবের বার্তা ভারতে ধর্ষণের অভিযোগে আওয়ামী লীগের ৪ নেতা গ্রেপ্তার ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে ঢাকায় আনার অনুরোধ প্রধান উপদেষ্টার সীমান্তহত্যার অসঙ্গতি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে: পররাষ্ট্রসচিব

ছাত্র–জনতার বিজয়, শেখ হাসিনার বিদায়

রিপোর্টার নাম:
আপডেট সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০২৪

বাংলার কথা ডেস্ক

ছাত্র ও জনতার ২৩ দিনের দেশ কাঁপানো আন্দোলনে পতন হলো আওয়ামী লীগ সরকারের। শেখ হাসিনা গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এরপর বঙ্গভবন থেকেই হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়েন। সে সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর বোন শেখ রেহানা।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তাঁর টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হলো। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের বিপুল সায় নিয়ে তিনি ক্ষমতায় বসেছিলেন। এরপর নিজের শাসনামলে আর কোনো গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন তিনি হতে দেননি।

শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ভোটাধিকার ও বাক্‌স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থ পাচার, দেশকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের কবলে ফেলা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, ঋণের নামে ব্যাংক লুটের সুযোগ দেওয়া, আয়বৈষম্য চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াসহ বিস্তৃত অভিযোগ রয়েছে। এসবের বিপরীতে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে। কিন্তু শেষ সময়ে অর্থনীতিকেও সরকার সংকটে ফেলেছিল। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) কমে গেছে, খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে, দ্রব্যমূল্য সীমিত আয়ের মানুষের নাগাল ছাড়া হয়ে গেছে।

দেশের মানুষের এসব সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের মন্ত্রীদের মুখে উপহাস শোনা যেত। কেউ কেউ বলতেন, দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েই ছিল। সেটার বহিঃপ্রকাশ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। উপলক্ষ তৈরি করে দেয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এর আগেও ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) আন্দোলনে (২০১৫) যার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল।

কোটা সংস্কার আন্দোলন লাগাতারভাবে শুরু হয় গত ১ জুলাই। ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’সংক্রান্ত এক বক্তব্য ও শিক্ষার্থীদের দাবিকে আইন-আদালতের চক্করে ফেলার পর তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে এসে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’

বাংলাদেশে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস কেউ পায়নি। নিবর্তনমূলক আইন, গুম, গ্রেপ্তার, হয়রানি ও চাপের মুখে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম ছিল কোণঠাসা। এই প্রথম শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন, স্লোগান দিলেন; শুরু হলো কোটা সংস্কার আন্দোলনের নতুন যাত্রা।

১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের দিন ছাত্রলীগকে নামিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। ওই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে। তারা প্রস্তুত। এরপরই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। দফায় দফায় ছাত্রীদেরও ধরে ধরে পেটানো হয়। গুলি করা হয় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে।

সত্যিই গুলি করা হবে, তা হয়তো ভাবতে পারেননি বিক্ষোভকারীরা। সাধারণ মানুষও ভাবতে পারেননি, কয়েক দিনেই ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হবে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেননি, ঘরের মধ্যে থাকা শিশু, ছাদে থাকা কিশোরী, বারান্দায় থাকা মানুষ গুলিতে নিহত হবেন। যদিও ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করার বিষয়টি জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘শুট অন সাইট’ বা দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছে।

বাংলাদেশে যা কখনো হয়নি, তা-ই হলো; বিপুল সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো, কলেজশিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো, স্কুলশিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো। মায়েরা কাঁদলেন, বাবারা কাঁদলেন, সহপাঠীরা কাঁদলেন। ক্ষোভে ফুঁসে উঠল দেশ। একে একে শিক্ষক, অভিভাবক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সমর্থন জানাতে শুরু করলেন শিক্ষার্থী ও তরুণদের আন্দোলনে।

শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ৯ দফা দাবি জানিয়েছিলেন। সেই দাবি পূরণের বদলে বেছে নেওয়া হয় নির্যাতন ও গণগ্রেপ্তারের পুরোনো পথ, যা শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ১৫ বছর ধরে প্রয়োগ করেছেন। কয়েক দিনের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাদ যায়নি এইচএসসি পরীক্ষার্থীরাও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুমকে তুলে নিয়ে আটকে রাখা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে। সেখান থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা দেওয়ানো হয়।

মানুষের প্রতিবাদ এবং সমন্বয়কদের অনশনের মুখে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ২ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ৯ দফা দাবিকে এক দফায় রূপান্তর করা হয়। বলা হয়, সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। ওদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানায়। পুলিশ আর গুলি করতে রাজি ছিল না। শেখ হাসিনা শেষ চেষ্টা হিসেবে নামিয়ে দেন তাঁর রাজনৈতিক শক্তিকে।

৪ আগস্ট ঢাকার রাস্তায় এবং দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করেন। তাঁদের কারও কারও হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, অনেকের হাতে ছিল দেশীয় অস্ত্র। ওই দিন সংঘর্ষে নিহত হন অন্তত ১১৪ জন মানুষ।

যদিও ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী লীগ বেশি সময় রাজপথে টিকতে পারেনি। ওই দিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ বা ঢাকামুখী গণযাত্রার ডাক দেওয়া হয়। গতকাল এই কর্মসূচির দিন সকালে কয়েকটি জায়গায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। দুপুর নাগাদ স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার নড়বড়ে হয়ে গেছে। বেলা আড়াইটায় হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা, যিনি কদিন আগেই (১ আগস্ট) বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা কখনো পালিয়ে যায় না।’

শেখ হাসিনা বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে তাঁর বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে উড্ডয়ন করেন। তিনি ভারতের আগরতলা হয়ে দিল্লি যান।

সব মিলিয়ে ১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট—শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার পর ২৩ দিনে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি পায় ‘অপশাসন’ থেকে।

শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার খবর শুনে যোগাযোগ করা হয় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শেখ হাসিনা কারও কথা শোনেননি। তাঁর কারণেই রোববার আওয়ামী লীগকে মাঠে নামতে হয়েছে। নিহত হয়েছেন ১১৪ জন মানুষ। শেষ পর্যন্ত তিনি দলের নেতা-কর্মীদের চরম সংকটে রেখে বিদেশ চলে গেলেন। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি ও বারবার ভুল পদক্ষেপের ফলে আওয়ামী লীগ এখন অস্তিত্বের সংকটে। নেতা-কর্মীরা হত্যার ঝুঁকিতে।

মিছিলে মিছিলে মুখর ঢাকা

বাংলাদেশে সোমবার ভোর হয়েছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। সকালটা ছিল মেঘলা, রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। বেলা ১০টার পর থেকে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, শহীদ মিনার, বাড্ডা, মিরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীদের জমায়েতের খবর আসতে শুরু করে। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও শুরু হয়।

বেলা সোয়া একটার দিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। তখনই মানুষ বুঝে যায়, পট বদলে যাচ্ছে। মানুষ একে একে ঘর থেকে বের হতে শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাস্তায় মানুষকে আর বাধা দেয়নি। বেলা আড়াইটায় শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরের পর লাখো মানুষের মিছিল, স্লোগানে মুখর হয় ঢাকা। এ যেন শ্রাবণ মাসে ‘বসন্ত’। এই বসন্ত মানুষের মুক্তির, এই বসন্ত নতুন বাংলাদেশের।

বিকেলের দিকে জনস্রোত গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। গণভবন থেকে যে যা পেরেছেন, তা নিয়ে গেছেন। এক ব্যক্তিকে দেখা যায় একটি বড় রুই মাছ নিয়ে যেতে। একজনের হাতে ছিল একটি টেলিভিশন ও একটি হাঁস। কেউ নিয়ে যাচ্ছিলেন মুরগি ও কবুতর। কেউ কেউ গণভবনের লেকে নেমে গোসল করছিলেন, কেউ কেউ মাছ ধরছিলেন। তাঁদের একজন নাহিদ জামাল। তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশে আর কোনো স্বৈরশাসক দেখতে চাই না।’

এদিকে গতকাল পুড়িয়ে দেওয়া হয় রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদন, তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি। হামলা হয় জাতীয় সংসদে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে। ছয় ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বিমানবন্দরের কার্যক্রম। জেলায় জেলায় হামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কার্যালয়ে। বিভিন্ন জায়গায় হামলা হয়েছে থানায়। ভাঙচুর করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা।

বিকেল চারটার দিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে কাজ পরিচালনা করব। ধৈর্য ধরেন, সময় দেন।’ তিনি সংঘাতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে সবাইকে শান্তিশৃঙ্খলার পথে ফিরে আসার আহ্বান জানান।

ওদিকে বিকেলে বঙ্গভবনে বিভিন্ন দলের নেতাদের ডাকা হয়। সেখানে নতুন সরকার কীভাবে হবে, তার কাঠামো কী হবে, তা নিয়ে মতামত নেওয়া হয়।

সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দেবেন তাঁরা।

’৫২ থেকে ’২৪

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—বাংলাদেশের মানুষ ২০২৪-এর জুলাইয়ের মতো এত মৃত্যু দেখেনি।

অতীতের আন্দোলনের মতো এবারের আন্দোলনেও সামনের সারিতে ছিলেন শিক্ষার্থীরা। এবারের বিশেষ দিক ছাত্রীদের, নারীদের বড় অংশগ্রহণ। আরেকটি দিক হলো, এবার লড়াই হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেল যখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে, অনলাইন মাধ্যমগুলো চাপে, তখন শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ ও আন্দোলনের আদর্শিক লড়াইয়ের পথ হয়ে ওঠে ফেসবুক, টুইটার। সেখানে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ, স্বজন হারানোর বেদনা, পুলিশের গুলি করার ভিডিও চিত্র। তাতে যুক্ত করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের গান, দেশপ্রেমের গান। নতুন নতুন স্লোগান, দেয়াললিখনও তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল ‘জেনারেশন জেড’, যারা সংক্ষেপে ‘জেন জি’ নামে পরিচিত। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ এই প্রজন্ম তাদের লড়াই তাদের মতো করে করেছে। তাদের ঠেকাতে বারবার ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। কখনো কখনো ইন্টারনেট চালু থাকলেও বন্ধ রাখা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তবে শিক্ষার্থীদের দমানো যায়নি। বিস্ময়করভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন আক্রান্ত হলেন, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এলেন।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, অতীতের আন্দোলনে সভা-সমিতির মাধ্যমে সংঘবোধ তৈরি হতো। নতুন প্রজন্ম সেটা তৈরি করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্য দিয়ে। মোটাদাগে দুটি বড় সমস্যায় তাঁরা ভুগছেন—গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা ও শোভন কর্মসংস্থানের অভাব। পাশাপাশি অনলাইন জগতে তাঁরা যেহেতু বিশ্বনাগরিক, সেহেতু তাঁরা আইনের শাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচারের অভাব বোধ করেন।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘একজন সরকারপ্রধানের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের সমস্যাগুলো মিটে যাবে বলে আমি মনে করি না। তাই নতুন সরকারকে তরুণদের প্রত্যাশাগুলো পূরণে কাজ করতে হবে।’

‘তাঁর দম্ভ দলটাকে ধ্বংস করল’

আওয়ামী লীগের বয়স ৭৫ বছর। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরে বাদ দেওয়া হয় মুসলিম শব্দটি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী কিছু সেনা কর্মকর্তার হাতে সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে আওয়ামী লীগ অনেকটা ছন্নছাড়া হয়ে যায়। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে; ক্ষমতায় এসে সেই আওয়ামী লীগই ২০১৪ সালের নির্বাচন করেছে বিরোধী দলের বর্জনের মুখে। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিত পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ভোটে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ছিল না। আওয়ামী লীগ নিজেদের দলের লোকদেরই ‘ডামি’ প্রার্থী করে ভোটের আয়োজন করে।

শেখ হাসিনা দলের ভেতরে নিজের ন্যূনতম বিরোধিতা এড়াতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করা নেতাদের কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। সামনে এনেছিলেন অনুগত নেতাদের। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন; পুলিশ ও আমলানির্ভর, দুর্নীতিবাজে ঘেরা একটি দল।

শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিলেন, পরে তিনিই পরিচিত হন গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে। শেখ হাসিনা সারের জন্য কৃষক খুন নিয়ে সোচ্চার ছিলেন, তাঁর ওপর এখন ছাত্রহত্যার দায়। চার শতাধিক (৪৩৫) মানুষ হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি বিদায় নিয়েছেন। গতকালই নিহত হয়েছেন অন্তত ১০৪ জন।

শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৬ বছর। শেখ হাসিনা আর রাজনীতি করবেন না বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এরশাদের চেয়ে শেখ হাসিনা শত গুণ বেশি খারাপ হয়ে বিদায় নিয়েছেন। এরশাদ পালিয়ে যাননি, তিনি পালিয়ে গেছেন। তিনি পালিয়ে গেছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ দলটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন। তাঁর হিংসা, দম্ভ, অহংকার দলটাকে ধ্বংস করল।

তারা কি ফিরিবে আজ

গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত সাড়ে তিন শ মানুষ। আহত বহু। কারও পা কেটে ফেলতে হয়েছে। কারও চোখ নষ্ট হয়ে গেছে।

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, ফারহান ফাইয়াজ, নাইমা সুলতানারা আর ফিরবেন না। তাঁদের স্মরণে ‘ভাইরাল’ হয়েছে মোহিনী চৌধুরীর লেখা গান, মুক্তির মন্দির সোপানতলে।

গানটির তিনটি লাইন—

‘তারা কি ফিরিবে আর

তারা কি ফিরিবে এই সুপ্রভাতে

যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে…।’

 

প্রথম আলোর খবর

বাংলার কথা/আগস্ট ০৫, ২০২৪


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরিতে আরো নিউজ